Sunday, December 30, 2018

আল্লাহর সুন্দর নাম সমুহ | আল ওয়াহিদ এবং আল আহাদ

আল ওয়াহিদ এবং আল আহাদ নামের ব্যাখ্যা 

মহান আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। অনন্তকাল ধরে তিনি তাঁর সত্বা, গুণাগুণ, কার্যাবলী, রুবুবিয়াত, উলুহিয়াত সব কিছুতেই অদ্বিতীয় ও অনন্য। তিনি এককভাবে সকল ইবাদত-বন্দেগীর হকদার।

কুরআনে আল ওয়াহিদ নামটি ২২ বার এবং আল আহাদ নামটি ১ বার উল্লেখিত হয়েছে।

আল্লাহ বলেন,
 

وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

এবং তিনি একক, পরাক্রমশালী ।” (সূরা রাদ: ১৬)

قُلْ هُوَ اللَّـهُ أَحَدٌ

বলুন, তিনি আল্লাহ এক ।” (সূরা ইখলাস: ১)

Share:

আল্লাহর সুন্দর নাম সমুহ | আর রব্ব


রব্ব নামের ব্যাখ্যা

মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা,অধিপতি, পরিচালক এবং প্রতিপালক। তিনি সৃষ্টি জগতকে অসংখ্য নিয়ামত সহকারে প্রতিপালন করেন আর তার প্রিয়ভাজনদেরকে এমনভাবে প্রতিপালন করেন যেন তাদের অন্তরগুলো সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকে।

কুরআনে এ নামটি ৯০০ বার উল্লেখিত হয়েছে।

যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন,  

الْحَمْدُ لِلَّـهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ


যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।” (সূরা ফাতিহা: ২)

Share:

আল্লাহর সুন্দর নাম সমুহ | আল্লাহ


আল্লাহ নামের ব্যাখ্যা

আল্লাহ শব্দের অর্থ মা’বুদ বা উপাস্য। তিনি সেই মহান আল্লাহ যার কাছে পৃথিবীর সকল সৃষ্টিলোক তাদের সকল অভাব অনটন ও বিপদ আপদে পরম ভালোবাসা, ভয়ভীতি ও বিনম্র ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে ছুটে যায়।

এই নামের মধ্যে তার সকল সুন্দর নাম ও গুণাবলির সমন্বয় ঘটেছে। 

·         কুরআনে এই নামটি মোট ২৭১৪ বার উল্লেখিত হয়েছে। 

·         যেমন আল্লাহ বলেনঃ 

إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي

  আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতিত কোন উপাস্য নেয়। এতএব, আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর।“ (সূরা ত্বাহাঃ ১৪)

Share:

Monday, February 5, 2018

হেদায়াত ও গোমরাহি সম্পর্কে ভুল ধারনা।

হেদায়াত ও গোমরাহি সম্পর্কে ভুল ধারনা।

হেদায়াত ও গোমরাহি নিয়ে মানুষের কিছু ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। এই অনুচ্ছেদে হেদায়াত ও গোমরাহি সম্পর্কে সকল ভুল ধারনা দূর করা হবে ইনশাআল্লাহ্‌।

এই অণুচ্ছেদটি নেওয়া হয়েছে আল-ফিকহুল আকবর, পঞ্চম আনুচ্ছেদ থেকে, গ্রন্থটি আনুবাদ করেছেন ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, আধ্যাপক, আল-হাদিস বিভাগ, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

আল্লাহ তা’আলা দয়া করে যাকে ইচ্ছা সুপথ প্রদর্শন করে। আর তিনি ন্যায়পরায়ণতা পূর্বক যাকে ইচ্ছা বিভ্রান্ত করে। বিভ্রান্ত করার অর্থ সাহায্য পরিত্যাগ করা। সাহায্য পরিত্যাগের ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ সে বান্দাকে তার সন্তুষ্টির পথে চলার তৌফীক প্রদান করেন না। বিষয়টি তার ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। আনুরুপভাবে যে পাপিকে তিনি পাপ ও অবাধ্যতার কারনে পরিত্যাগ করেছেন তার পাপের কারনে শাস্তি পদানও তার ন্যায়পরায়ণতার প্রকাশ। আমাদের জন্য এই কথা বলা বৈধ নয় যে, শয়তান জবরদস্তি বা জোর করে মুমিন বান্দার ঈমান কেরে নেয়। বরং আমরা বলিঃ বান্দা যখন তার ইমান পরিত্যাগ করে, তখন শয়তান তা তার থেকে ছিনিয়ে ন্যায়।



মহান আল্লাহ কুরআনে বারবার উল্লেখ করেছেন যে, তিনি যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন বা পথভ্রষ্ট করেন। যেমন আল্লাহ তা’আলা কুরআনে সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪ এ বলেছেনঃ “আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার জাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়; অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ প্রদর্শন করেন। আর তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়”।
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেনঃ “আল্লাহ যাকে হেদায়াত করতে চান তার বক্ষ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন। আর যাকে তিনি পথভ্রষ্ট করতে চান তার বক্ষকে সংকীর্ণ-সংকুচিত করে দেন; যেন সে আকাশে-ঊর্ধ্বে আহরন করছে। এভাবেই আল্লাহ অকল্যাণ দেন তাদের উপর যারা ঈমান আনে না।” আয়াত ১২৫, সূরা-আনআম।




পাশাপাশি কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঈমান আনয়ন বা সত্য গ্রহণ মানুষের নিজের ইচ্ছাধীন কর্ম।

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আর বল, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে সত্য; কাজেই যে ইচ্ছা করে সে ঈমান গ্রহণ করুক এবং যে ইচ্ছা করে সে কুফরি করুক।”

অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ “নিশ্চয় এ এক উদ্দেশ্য; অতএব যে চায় সে তার রবের দিকে পথ গ্রহণ করুক।”

মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে কি করবে আল্লাহ তা জানেন। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তার ইচ্ছা ও কর্মে বাধা দিতে পারেন বা তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করতে পারেন। তিনি তার কোনো বান্দার ইচ্ছা বা কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অতিরিক্ত তাওফিক বা কল্যাণে সহায়তা প্রদান করে। আর এই অর্থে তিনি বলেছেন- “যাকে ইচ্ছা করেন তাকে তিনি হেদায়াত করেন।” তার হেদায়াত অর্থ তার তাওফিক বা তার পক্ষ থেকে অতিরিক্ত করুনা। পক্ষান্তরে যার ইচ্ছা ও কর্মে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন তাকে এরুপ তাওফিক বা মঙ্গলে সহায়তা প্রদান থেকে তিনি বিরত থাকেন; বরং তাকে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেন। তখন সে স্বাধীন ইচ্ছা ও প্রবিত্তির অনুসরণ করে বিপথগামী হয়। এই অর্থেই তিনি বলেছেন- “যাকে ইচ্ছা তিনি তাকে পথভ্রষ্ট করেন।” কাউকে তার ইচ্ছা ও কর্মের কারনে অতিরিক্ত তাওফিক ও করুনা থেকে বিরত থাকা ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়। এরূপ ব্যক্তির ইচ্ছা ও কর্মের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়াও ইনসাফের ব্যতিক্রম নয়।

আশা করি সবাই হেদায়াত ও গোমরাহি বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পেরেছেন। যদি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করুন। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে পষ্টটি শেয়ার করুন। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকল ভুলত্রুটি ক্ষমা করে আমাদের সবাইকে হেদায়াত দান করুন। আমিন।
Share:

Wednesday, January 31, 2018

সেজদাহে দোয়া করা যাবে কি না বা করা গেলেও বাংলাই করা যাবে কি না ?

সেজদাহে দোয়া করা যাবে কি না বা করা গেলেও বাংলাই করা যাবে কি না ?




উত্তরঃ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেষ ওয়াছিওত- রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ, সোমবার দিন সাহাবিরা ফজর সালাত আদায় করবেন তখন সাহাবিরা দেখলেন রাসুলুল্লাহ (সঃ) একটু সুস্থ আনুভব করছেন (অসুস্থ ছিলেন)। সাহাবিরা রাসুল (সঃ) দেখে এগিয়ে আসতে চাইলে রাসুলুল্লাহ (সঃ) দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো অবস্থায় ইশারা করলেন তোমরা থাকো। রাসুলুল্লাহ (সঃ) বললেন-“রুকুতে তোমরা রবের তাযীম প্রকাশ করবে, যখন সেজদাহ করবে তখন বেশি বেশি দোয়া করবে”। কাজেই সেজদায় দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি, তাই আমরা সিজদাহে বেশি বেশি দোয়া করবো, তবে আমাদের চাওয়ার ভাষাটা হবে আল্লাহ্‌র কাছে চাওয়ার ভাষা, বিনয়ী ভাষা। রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর শেখানো দোয়াগুলো করলে ভালো হয় এছাড়াও আমরা যেকোনো কিছু চায়তে পারি, দুনিয়া হক, আখেরাত হক যেকোনো কিছু। আমাদের দেশে যে ধরনের ফিকাহ কিতাবগুলো পরানো হয় বা আমাদের দেশের আলেম ঊলামাদের মতে মাতৃভাষায় দোয়া করা মাখরু, কেঁউ কেঁউ বলেছে মাখরু তাঞ্জি (অনুচিত), বেশি মাখরু তাহরিম। এটা হল আমাদের দেশের হানাফি মাজহাবি ফকিহগনের মত তবে হানাফি মাজহাবি ফকিররা যারা মিশর সাঊদি আরব, মিশর, তুরস্ক, সিরিয়া আছেন তারা বলেন মাতৃভাষায় সেজদাহে দোয়া করা কোন দোষ হতে পারে না। বরং দোয়া তো বান্দা আল্লাহ্‌র কাছে নিজের ভাষাতেই করবেন। এজন্য সেজদাহে দোয়া কোরআনের ভাষাতেই করবো যদি কেঁউ না পারে তাহলে নফল সালাতে তাহাজ্জুদ সালাতে মাতৃভাষায় দোয়া করতে পারেন বিষেশ করে কোরআন বা হাদিসে যে দোয়াগুলো এর অর্থগুলো মনের আবেগে বলতে পারেন।

ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

Share:

Tuesday, May 9, 2017

সূরা আসর আমাদের যা শেখায় | বাংলা তাফসীর

সূরা আসর আমাদের যা শেখায়

লেখকঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন নাযিল করেছেন মানুষের জন্য উপদেশ ও জীবন বিধান হিসাবে। এ লক্ষ্যেই তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি :


أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآَنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا

‘তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তরসমূহে তালা রয়েছে?’ (মুহাম্মাদ : ২৪)



কুরআন নিয়ে যতই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা হবে অন্তরে কুরআনের আবেদন ও কুরআনের প্রতি ভক্তি ততই বৃদ্ধি পাবে। মানুষের স্বভাব চরিত্রে, আচার-আচরণে এর প্রভাব পড়বে। তাই তো আমরা দেখি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা রা. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন:

كان خلقه القرآن

‘তাঁর চরিত্র ছিল আল কুরআন।’ (মুসলিম)


কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনকে নিজের জীবনের পাথেয় হিসেবে নিয়েছিলেন। এতে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করেছেন এবং নিজ জীবনে তা পূর্ণাঙ্গরূপেবাস্তবায়ন করেছেন। আমরা আজ কুরআন পাঠ করি কিন্তু তা আমাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলে না। আমাদের জীবনাচারে পরিবর্তন সূচিত করে না। কারণ আমরা কুরআনের মর্ম নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনা করি না। আলী রা. বলেছেন, ‘যে কুরআন পাঠে চিন্তা-ভাবনা নেই, সে পাঠে কোনো কল্যাণ নেই।’ আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, ‘আজ তোমরা সূরা ফাতেহা থেকে নিয়ে শেষ পর্যস্ত এমনভাবে কুরআন খতম করো যে, একটি হরফও বাদ পড়ে না। কিন্তু বাস্তব কথা হল, সে অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন বাদ পড়ে যায়।’
আমরা সূরা আল আসর পাঠ করি। তা মুখস্থও করেছি । জীবনে কতবার যে পাঠ করেছি তার হিসেব তো নিজের কাছেও নেই; কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি ছোট এই সূরাটির মধ্যে আল্লাহ তাআলা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রেখেছেন। কত চমৎকার হেদায়েত রেখেছেন ক্ষুদে এ সূরাটির মধ্যে। ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির স্পষ্ট সনদ রেখেছেন তিনি মাত্র তিন আয়াত বিশিষ্ট এ সূরার মধ্যে। সাহাবায়ে কেরামের অনেকের সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তারা যখন একজন অপর জনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতেন তখন সূরা আল আসর পাঠ করে শুনাতেন। (তাবরানি, হায়সামি ফি মাজমাআয যাওয়ায়েদ)

ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা যদি কুরআনে অন্য কোনো সূরা নাযিল না করে শুধু সূরা আল আসর নাযিল করতেন তাহলে এটা মানুষের হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট হত।'(মিফতাহুস সাআদাহ : ইমাম শাফেয়ি)

যদি কেউ এ সূরায় গভীরভাবে দৃষ্টি দেয় তাহলে সে তাতে একটি উন্নত, সুন্দর, শান্তিময়, পরিপূর্ণ এবং সবার জন্য কল্যাণকর সমাজের চিত্র দেখতে পাবে। (আদওয়াউল বায়ান : ৯/৫০৭)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ সূরাটি শুরু করেছেন ‘ওয়াল আসর’ শব্দ দিয়ে। ইরশাদ হয়েছে-

وَالْعَصْرِ ﴿1﴾

১) ‘আসরের শপথ।’


‘আসর’ বলতে কি বুঝানো হয়েছে?
‘আসর’ শব্দের দুটো অর্থ : এক. যুগ বা সময়। দুই. আসরের নামাজের সময়, যার আগমন হয় জোহরের নামাজের সময় শেষ হওয়ার পর এবং শেষ হয় সূর্যাস্তের মধ্য দিয়ে। আল্লাহ তাআলা কোনটির শপথ করেছেন? সময়ের শপথ না আসরের ওয়াক্তের শপথ?

সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত হল তিনি ‘আসর’ বলতে এখানে সমস্ত সময়ের শপথ করেছেন। করেছেন যুগের শপথ। আর যুগের গর্ভেই এক জাতির উত্থান ঘটে, অন্য জাতির ঘটে পতন। রাত্রি আসে। যায় দিন। পরিবর্তিত হয় পরিবেশ ও মানব সমাজ। এমন সব পরিবর্তন আসে যা মানুষ কল্পনা করতে পারে না। কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত কখনো বা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিবর্তন আসে এ সময়ের ব্যবধানেই। তাই এ যুগ বা সময় বড় বিস্ময়কর। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানব, দানব, জীব-জন্তুসহ তাবৎ সৃষ্টিকুলের জন্য। এটা বুঝানোর জন্যই আল্লাহ তাআলা সময়ের শপথ করেছেন। (আত তিবইয়ান ফি আকসামিল বায়ান : ইবনুল কায়্যিম আল জাওযি)

কোনো বস্তু বা বিষয়ের শপথ করলে তার অস্বাভাবিক গুরুত্ব বুঝায়। সময় এমনই এক বিস্ময়ের আধার যে, আমরা জানি না অতীতকালে এটা কি কারণে হয়েছে। আমরা জানি না ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে। এমনকি আমাদের নিজেদের জীবন, নিজের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা বলতে পারি না যে আগামী কালকের পরিবশেটা ঠিক আজকের মত থাকবে কি থাকবে না। দেখা যায় মানুষ নিজ সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। আগামীকাল এটা সে বাস্তবায়ন করবে। অর্জন করবে এটা সেটা অনেক কিছু। সে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে। সব উপকরণ থাকে হাতের নাগালে। সব মাধ্যম ও ফলাফল থাকে আপন নখদর্পনে। কোনো কিছুরই অভাব নেই। তবুও এ ‘সময়’ নামক বস্তুটির ব্যবধানে এমন কিছু ঘটে যায় যা তার সব কিছুকে তছনছ করে দেয়। সে ভাবতেই পারে না- কেন এমন হল। অনেক বড় বড় হিসাব সে মিলিয়েছে কিন্তু এর হিসাব সে মেলাতে পারছে না। এটাই হল ‘সময়’। আল্লাহ তাআলা এর প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই বলেছেন, ‘ওয়াল আসর’ – শপথ সময়ের।

এ থেকে আমরা জীবনের জন্য সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। আমাদের মনে রাখতে হবে আল্লাহ হলেন মহান। তিনি মহান বস্তু ব্যতীত অন্য কোনো কিছুর শপথ করেন না।

তাফসিরবিদ ইকরামাসহ অনেকে বলেছেন, ‘আসর’ বলতে এখানে আসরের নামাজের সময়ের শপথ করা হয়েছে। কেননা আসর নামাজের সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ ইবনে জারির আত তাবারী রহ. বলেছেন, ‘সঠিক কথা হল এখানে ‘আসর’ বলতে আল্লাহ তাআলা ‘সময়’ কে বুঝিয়েছেন। যুগের অপর নাম সময়। সকাল, বিকাল, দুপুর, রাত, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী, সহস্রাব্দ ইত্যাদি সব কিছুই বুঝায় এ ‘আসর’ বা ‘সময়’ নামক শব্দ। (জামেউল বায়ান : ১৫/২৮৯)

যদি এ সূরাটির প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি দেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে যে, সময়টাকে সকল যুগে টেনে নেয়া হয়েছে। মানুষকে সময়ের মধ্যে আবদ্ধ করা হয়েছে। সময় ছাড়া মানুষের জীবন যেমন সচল নয়, তেমনি সময় ব্যতীত তাদের কোনো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতও নেই।

দ্বিতীয় আয়াত :


إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ﴿2﴾

২) ‘অবশ্যই মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত।’


যদিও এখানে ইনসান বা মানুষ শব্দটি এক বচনে ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু তার পূর্বে জাতিবাচক আলিফ লাম ব্যবহার করে পুরো মানব জাতিকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পুরো মানবগোষ্ঠি ক্ষতিগ্রস্ত। তারা সকলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে যাদের মধ্যে চারটি গুণ আছে তারা ব্যতীত। এ চারটি গুণের অধিকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত নয়। তারা লাভবান সর্বদা। লাভবান ইহকাল ও পরকালে। পরবর্তী আয়াতে এ চারটি গুণের কথাই বর্ণিত হয়েছে।

তৃতীয় আয়াত :

إِلَّا الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿3﴾



৩) ‘তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’



চারটি গুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

এক. ঈমান

দুই. সৎকাজ বা আমালে সালেহ

তিন. অন্যকে সত্যের পথে আহবান

চার. অন্যকে ধৈর্যের উপদেশ দান
একজন মুসলিম শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে না। নিজের সুখে সন্তুষ্ট থাকে না। যেমন সে নিজের দুঃখেই শুধু ব্যথিত হয় না। অন্যের কথা চিন্তা করতে হয় তাকে। অন্যের কল্যাণে কাজ করতে হয়। অন্যের দুখে দুখী ও অন্যের সুখে সুখী হওয়া তার কর্তব্য। এজন্য এ চারটি গুণের প্রথম দুটো গুণ নিজের কল্যাণের জন্য আর পরের গুণ দুটো হল অন্যের কল্যাণের জন্য। প্রথম গুণ দুটো দ্বারা একজন মুসলিম নিজেকে পরিপূর্ণ করে, আর অপর দুইগুণ দ্বারা অন্যকে পরিপূর্ণ করার প্রয়াস পায়।

প্রথম গুণটি হল ঈমান। এটা একটা ব্যাপকভিত্তিক আদর্শের নাম। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ মুজাহিদ রহ. বলেছেন, ঈমান হল, আল্লাহকে এক বলে বিশ্বাস করা, তাঁর একত্ববাদকে সর্বক্ষেত্রে গ্রহণ করা। তাঁর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সবগুলোকে মেনে নেয়া এবং সর্বক্ষেত্রেই তার কাছে জওয়াব দিতে হবে এ আদর্শ ধারণ করা। (তাফসিরে তাবারি)

ঈমানের পর নেক আমল বা সৎকর্মের স্থান। সৎকর্ম কম বেশি সকল মানুষই করে। তবে ঈমান নামক আদর্শ তারা সকলে বহন করে না। ফলে তাদের আমল বা কর্মগুলো দিয়ে লাভবান হওয়ার পরিবর্তে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। সৎকর্মশীল মানুষগুলো যদি ঈমান নামের আদর্শকে গ্রহণ করে তাহলে এ সৎকর্ম দ্বারা তারা দুনিয়াতে যেমন লাভবান হবে আখেরাতেও তারা অনন্তকাল ধরে এ লাভ ভোগ করবে। আর যদি সৎকর্মের সঙ্গে ঈমান নামের আদর্শ না থাকে, তাহলে সৎকর্ম দিয়ে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনে কিছুটা লাভবান হলেও আখেরাতের স্থায়ী জীবনে এটা তাদের কোনো কল্যাণে আসবে না। এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রথমে ঈমানের কথা বলেছেন।

সৎকর্ম হল, যা কিছু ইসলাম করতে বলেছে সেগুলো পালন করা আর যা কিছু নিষেধ করেছে সেগুলো থেকে বিরত থাকা। হতে পারে তা ফরজ, ওয়াজেব, সুন্নাত, মুস্তাহাব বা নফল। আর বর্জনীয় বিষয়গুলো বর্জন করে চলা। হতে পারে তা হারাম, মাকরূহ।যখন মানুষ ঈমান স্থাপন করল, তারপর সৎকর্ম করল, তখন সে নিজেকে পরিপূর্ণ করে নিল। নিজেকে লাভ, সফলতা ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করল। কিন্তু ঈমানদার হিসাবে তার দায়িত্ব কি শেষ হয়ে গেল? সে কি অন্য মানুষ সম্পর্কে বে-খবর থাকবে? কিভাবে সে এত স্বার্থপর হবে? অন্য সকলকে কি সে তার যাপিত কল্যাণকর, সফল জীবনের প্রতি আহবান করবে না? কেনই বা করবে না? সে তো মুসলিম। তাদের আভির্ভাব ঘটানো হয়েছে তো বিশ্ব মানবের কল্যাণের জন্য। আর এ জন্যই তো মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। আল্লাহ তাআলা তো বলেই দিয়েছেন :


كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ


‘তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ (আলে ইমরান : ১১০)

অতএব নিজেকে ঠিক করার পর তার দায়িত্ব হবে অন্যকে কল্যাণের পথে আহবান করা। তাই ঈমান ও সৎকর্ম নামক গুণ দুটো উল্লেখ করার পর আল্লাহ তাআলা আরো দুটো গুণের কথা বললেন :


وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ



‘আর তারা পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।’

সত্যের দিকে মানুষকে আহবান করা, এ আহবান করতে গিয়ে ও আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে যে সকল বিপদ-মুসিবত, অত্যাচার-নির্যাতন আসবে তাতে ধৈর্য ধারনের জন্য একে অন্যকে উপদেশ দেয়া কর্তব্য। প্রশ্ন হতে পারে সত্যের মধ্যেই তো ধৈর্য আছে। ধৈর্য তো হক বা সত্যের একটি। তাহলে এটা আলাদাভাবে উল্লেখ না করলে কি হত না? কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বুঝাতে সাধারণভাবে তা উল্লেখ করা হলেও আবার বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। পরিভাষায় এটাকে বলা হয় : ذكر الخاص بعد العام

কোনো বিষয় অর্জন করা সহজ হতে পারে কিন্তু সেটি ধরে রাখা ও তার ওপর অটল থাকা ততটা সহজ নাও হতে পারে। আর এ জন্যই প্রয়োজন ধৈর্য ও সবরের।

সূরা থেকে অর্জিত শিক্ষা ও মাসায়েলসমূহ :

১- এ সূরার মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে, চারটি বিষয় অর্জন করা আমাদের জন্য জরুরি :

এক. ইলম বা জ্ঞান অর্জন। ইলম ব্যতীত ঈমান স্থাপন সম্ভব নয়। ঈমানের জন্য কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। (ক) আল্লাহ তাআলাকে জানতে হবে। (খ) তাঁর রাসূলকে জানতে হবে। (গ) তাঁর প্রেরিত দীন-ধর্মকে জানতে হবে। এগুলো জানার পরই তার ওপর ঈমান আনা সম্ভব। ইরশাদ হয়েছে:



فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘অতএব জেনে নাও যে, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং তুমি ক্ষমা চাও তোমার ও মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য।’ (মুহাম্মাদ : ১৯)

আমরা দেখলাম, এ আয়াতে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর প্রতি ঈমান আনার পূর্বে জানতে বলেছেন অর্থাৎ ইলম অর্জন করতে বলেছেন। তারপর ইস্তেগফার তথা আমল করতে বলেছেন।

দুই. ইলম অনুযায়ী কাজ করা। তিনটি বিষয় -আল্লাহ, রাসূল ও দীন সম্পর্কে ইলম অর্জন করে আল্লাহর প্রতি ঈমান স্থাপন করার পর সেই ইলম বা জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতে হবে।

তিন. অন্যকে এই ইলম ও আমলের দিকে আহবান করতে হবে বা দীনে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে।

চার. ধৈর্য ধারন করা। ইলম, ঈমান, আমল ও দাওয়াত দিতে গিয়ে যে সকল বিপদ-মুসীবত, দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিতে হবে। এছাড়া সকল প্রকার বিপদ মুসিবতে, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

২- আল্লাহ তাআলা ‘আল আসর’ তথা সময়, হায়াত, যুগের শপথ করেছেন। এ শপথের মাধ্যমে তিনি আমাদেরকে সময় ও জীবনের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন। মানুষের আয়ু কত মূল্যবান তা অনুধাবন করতে বলেছেন। তেমনি ‘আল আসর’ এর কসম করে যা বলেছেন সেটারও গুরুত্ব বুঝিয়েছেন তিনি। আর তা হল; মানুষ ক্ষতিতে নিপতিত। মানুষ ধ্বংসের দিকে ধাবিত। তাই ক্ষতির পথ ছেড়ে তাকে লাভ ও কল্যাণের পথে আসতে হবে। যারা ক্ষতিগস্ত হচ্ছে তারা কিন্তু সময়টাকে বর্ণিত কাজগুলোতে লাগাচ্ছে না বলেই তারা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

৩- আল্লাহ তাআলা যুগের শপথ করেছেন। যুগে যুগে যা কিছু ঘটেছে সেগুলো ইতিহাস। তাতে রয়েছে মানুষের জন্য শিক্ষা ও নসিহত। যুগে যুগে অত্যাচারী শক্তিধর জাতির পতন ঘটেছে। নির্যাতিত দুর্বল জাতির উত্থান হয়েছে। এসবই মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও তাঁর সর্বময় ক্ষমতার প্রমাণ।

৪- মানুষ দুনিয়াতে আয়ু পার করে বার্ধক্যে উপনীত হয় বটে কিন্তু সে লাভবান হয় না। তবে যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে, মানুষকে সত্যের পথে আহবান করেছে, ধৈর্য ধারণ করেছে তারা এর ব্যতিক্রম। তারা বৃদ্ধ অক্ষম হয়ে গেলেও তাদের নামে সৎকর্ম যোগ হতে থাকে। যেমন আবু মুসা আশাআরী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একাধিকবার বলতে শুনেছি-



إذا كان العبد يعمل عملا صالحا فشغله عنه مرض أو سفر كتب له كصالح ما كان يعمل وهو صحيح مقيم.


‘কোন মানুষ যখন সৎকর্ম করতে থাকে, পরে তাকে রোগ-ব্যধি পেয়ে বসে অথবা সফর অবস্থায় থাকে, তখন তার কর্ম বিবরণীতে সে আমলগুলো লেখা হতে থাকে, যেগুলো সে সুস্থ ও গৃহে থাকাবস্থায় করে আসছিল।’ (বুখারি, জিহাদ অধ্যায়


৫- মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকভাবে হতে পারে : প্রথম. কুফরি করার মাধ্যমে
ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন


وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ

আর অবশ্যই তোমার কাছে এবং তোমার পূর্ববর্তীদের কাছে ওহি পাঠানো হয়েছে যে, তুমি শির্ক করলে তোমার কর্ম নিষ্ফল হবেই। আর অবশ্যই তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (যুমার : ৬৫
দ্বিতীয়. মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম কম হয়ে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন


وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَأُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ


আর যাদের পাল্লা হালকা হবে তারাই নিজদের ক্ষতি করল।’(মুমিনূন : ১০৩
তৃতীয়. সত্য তথা ইসলাম গ্রহণ না করে অন্য আদর্শ গ্রহণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :




وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ


‘আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (আলে ইমরান : ৮৫)

চতুর্থ. ধৈর্য ধারণ না করে হতাশ হয়ে পড়ার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন :

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرٌ اطْمَأَنَّ بِهِ وَإِنْ أَصَابَتْهُ فِتْنَةٌ انْقَلَبَ عَلَى وَجْهِهِ خَسِرَ الدُّنْيَا وَالْآَخِرَةَ ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ

‘মানুষের মধ্যে কতক এমন রয়েছে, যারা দ্বিধার সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি তার কোনো কল্যাণ হয় তবে সে তাতে প্রশান্ত হয়। আর যদি তার কোনো বিপর্যয় ঘটে, তাহলে সে তার আসল চেহারায় ফিরে যায়। সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি হল সুস্পষ্ট ক্ষতি।’ (হজ : ১১)

৬- ঈমানের আভিধানিক অর্থ, সত্যায়ন করা, স্বীকার করা, মেনে নেয়া।

পারিভাষিক অর্থ, হাদিসে জিবরিলে বর্ণিত ঈমানের যে ছয়টি ভিত্তি আছে তার

সবগুলোর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা। একটু বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বলা যায়, ঈমান হল : অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করা, মুখ দিয়ে স্বীকার করা আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা। তাই শুধু বিশ্বাস দিয়ে কাজ হবে না, যদি না সে বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করা হয়।

৭- আমর বিল মারুফ ওয়ান নাহি আনিল মুনকার অর্থাৎ অন্যকে সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা যেতে পারে। সত্যের পথে মানুষকে আসার উপদেশ দেয়া মানে সৎকাজের আদেশ করা। এর জন্য প্রয়োজন হবে ধৈর্যের। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন লুকমান হাকিমের উপদেশ উল্লেখ করেছেন। সেখানেও এ বিষয়টি দেখা যায়। লুকমান তার ছেলেকে বলেছিলেন :

يَا بُنَيَّ أَقِمِ الصَّلَاةَ وَأْمُرْ بِالْمَعْرُوفِ وَانْهَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَاصْبِرْ عَلَى مَا أَصَابَكَ إِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ

‘হে আমার প্রিয় বৎস, সালাত কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং তোমার ওপর যে বিপদ আসে তাতে ধৈর্য ধর। নিশ্চয় এগুলো অন্যতম দৃঢ় সংকল্পের কাজ।‘ (লুকমান : ১৭)

৮- আমালে সালেহ বা সৎকর্মের মধ্যে হুকুকুল্লাহ (আল্লাহর অধিকার) ও হুকুকুল ইবাদ (মানুষের অধিকার) দুটোই অন্তর্ভুক্ত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির গুরুত্ব দেয়ায় কাজ হবে না। তাওহিদে বিশ্বাস, ঈমানে কামেল, ইবাদত-বন্দেগি, ফরজ-ওয়াজিব ও সুন্নাত-মুস্তাহাব আমলগুলো যেমন সৎকর্ম তেমনি পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী-সহযাত্রীদের সঙ্গে সদাচারণ, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করাও সৎকর্মের অন্তর্ভুক্ত। দেখুন কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের অধিকার বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অধিকার সংরক্ষণের কথাও বলেছেন :

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا

‘তোমরা ইবাদাত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে, ইয়াতিম, মিসকিন, নিকট আত্মীয়- প্রতিবেশী, অনাত্মীয়- প্রতিবেশী, পার্শবর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (নিসা : ৩৬)

৯- সবর বা ধৈর্য তিন প্রকার : (ক) আল্লাহর আনুগত্যে ধৈর্য ধারণ করা। তাঁর আদেশ নির্দেশগুলো মানতে গিয়ে অধৈর্য না হওয়া। এটাকে বলা হয় : الصبر على طاعة الله


(খ) আল্লাহর অবাধ্য না হওয়ার ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তাআলা যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোর ধারে কাছে না গিয়ে ধৈর্য অবলম্বন করা। এটাকে বলা হয় : الصبر عن معصية الله

(গ) উপস্থিত বিপদ-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা। এটাকে বলা হয় : الصبر على أقدار الله

১০- সূরা আল বালাদেও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়ার নির্দেশ এসেছে, সেখানে এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। যেমন :

ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ ﴿17﴾ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ ﴿18﴾

‘অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের। তারাই সৌভাগ্যবান।’

এ আয়াতে মুমিনদের গুণাবলি উল্লেখ করতে গিয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, তারা ধৈর্য ধারণ আর পরস্পরকে দয়া-অনুগ্রহ করার উপদেশ দেয়।

তারা ডানদিকের দল। তাই একজন মুমিন যেমন নিজে ধৈর্য ধারণ করে ও অন্যকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়, তেমনি সে নিজে দয়া অনুগ্রহ করে ও অন্যকে দয়া অনুগ্রহ করতে উদ্বুদ্ধ করে।

আল্লাহ আমাদেরকে সূরা আল আসরের শিক্ষাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তাউফিক দান করুন।
Share:

Tuesday, June 21, 2016

ভালোবাসাঃ আল্লাহ্‌র জন্য।


ভালোবাসাঃ আল্লাহ্‌র জন্য।


Tafsirul Quran
Tafsirul Qur'an 
যারা পরস্পরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্যে ভালোবাসে তাদের মর্যাদা অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। জান্নাতে তাদের উচ্চ সম্মানিত স্থানের কথা ওয়াদা করা হয়েছে এবং যেদিন সমগ্র মানব জাতিকে তাদের রবের সম্মুখে দাঁড় করানো হবে বিচারের জন্যে, সেদিন আল্লাহ তায়ালা যে সম্মান তাদেরকে দান করবেন তাও বর্ণিত হয়েছে।

হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ ৭ শ্রেণীর লোকদের মহান আল্লাহ সেদিন তাঁর সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর ছাড়া অন্য কোন ছায়াই থাকবে না। তাঁরা হলেনঃ

১ ন্যায়বিচারক শাসক বা নেতা
২ মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল যুবক
৩ মসজিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হৃদয়ের অধিকারী
৪ যে দুজন লোক একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব করে এবং এ জন্যেই আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়

৫ এরূপ ব্যক্তি যাকে কোন অভিজাত পরিবারের সুন্দরী নারী খারাপ কাজে আহবান করেছে, কিন্তু সে বলে দিল, আমি আল্লাহকে ভয় করি

৬ যে ব্যক্তি এতো গোপনভাবে দান-খয়রাত করে যে, তার ডান হাত কি দান করলো, বাঁ হাতেও তা জানতে পারলো না

৭ এরূপ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকির করে এবং দু’চোখের পানি ফেলে (কাঁদে)।
[বুখারী ও মুসলিম]

যে দুজন পরস্পরকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসে তাদের জন্যে স্পষ্টভাবে সুসংবাদ জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহর আরশের ছায়াতলে আশ্রয় লাভ করবে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদের উপর তাঁর অসীম রহমত ও করুণা বর্ষিত করবেন। কত বিরাট এই সম্মান ! এই সম্মানই তো যথেষ্ট যে, যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসে তাদেরকে শেষ বিচারের দিন ডাকা হবে এবং বলা হবে ; “কোথায় তারা যারা একে অপরকে আমার সম্মানে ভালোবেসেছো ? আজ তাদেরকে আমি আমার ছায়াতলে আশ্রয় দান করব যখন আমার (আরশের) ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া নেই” (মুসলিম) এরকম সুমহান মর্যাদা ও সমুন্নত সম্মান তাদের যোগ্য প্রাপ্য যারা কিনা আল্লাহর জন্যেই পরস্পরকে ভালোবাসে।

এই পৃথিবী যা কিনা লোভ, লালসা এবং স্বার্থপরতায় পরিপূর্ণ; সেখানে বসবাস করে কাউকে শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে ভালোবাসা, অন্য কোন কিছুর জন্যে নয় ; তা বেশ কঠিন নয় কি? পবিত্র ও বিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী ব্যতীত অন্য কেউ এই ভালোবাসা অর্জন করতে পারে না, যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসে তাদের নিকট এই দুনিয়ার জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, আল্লাহ তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করবেন অন্যদের উপরে যারা দুনিয়ার ভালোবাসায় ডুবে রয়েছে। আমরা এর প্রমাণ পাই হযরত মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীসটিতে যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন;“আল্লাহ (সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা ) বলেন; ‘যারা আমার সম্মানে পরস্পরকে ভালোবাসে, তারা নূরের মিম্বার লাভ করবে, এবং নবীগণ ও শহীদগণও অনুরূপ ইচ্ছা করবেন” [তিরমিযি কর্তৃক হাসান সহীহ হাদীস]

যারা পরস্পরকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসে তাদেরকে সুমহান আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন তাঁর রহমত ও করুণার পাশাপাশি আরো একটি দুর্লভ অনুগ্রহ দান করবেন, যা কিনা অর্জন করা খুবই কঠিন। আর তা হল মহান প্রতিপালকের নিজের পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি ভালোবাসা ! হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “একটি লোক অপর একটি গ্রামে তার ভাইকে দেখতে গেল। আল্লাহ তায়ালা একজন ফেরেশতাকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি লোকটির জন্যে রাস্তায় অপেক্ষা করতে থাকলেন। যখন লোকটি আসল, তখন ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যেতে মনস্থির করেছ?’ লোকটি বলল, ‘আমি আমার এক ভাইকে দেখতে যাচ্ছি যে এই গ্রামে থাকে’। ফেরেশতা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ তুমি কি তার প্রতি কোন অনুগ্রহ করেছ(যার কারণে তুমি প্রতিদান আশা কর)?’ । সে বলল, ‘না। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যেই তাকে ভালোবাসি।’ ফেরেশতা তাকে বললেন, ‘আমি আল্লাহর পক্ষ হতে তোমার নিকট প্রেরিত একজন দূত, তিনি(আল্লাহ) তোমাকে ভালোবাসেন যেরকম তুমি তোমার ভাইকে তাঁর জন্যে ভালোবাসো, আমি তোমাকে এটা বলার জন্যই প্রেরিত হয়েছি।” (মুসলিম)

কত অসাধারণ এই ভালোবাসা ! যা একজন মানুষকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যায় যখন স্বয়ং আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন !

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা হতে জানা যায় যে, দুই ব্যক্তির মধ্যে সে উত্তম যে অপরকে আল্লাহর জন্যে বেশি ভালোবাসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “এমন কোন দুই ব্যক্তি নেই, যে কিনা তার ভাইয়ের প্রতি অধিক ভালোবাসা পোষণ করে অথচ সে অপরজন অপেক্ষা উত্তম নয় “। [বুখারী, আদাব-আল-মুফরাদ]

ইসলামের শিক্ষা ভালোবাসা ছড়াতে সাহায্য করে, একটি সুস্থ সমাজ গঠনে সহায়তা করে। কেউ যদি তার মুসলিম ভাইকে ভালোবাসে তার উচিত তাকে জানিয়ে দেয়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “যদি কোন ব্যক্তি তার ভাইকে ভালোবাসে, তাকে বলতে দাও যে সে তাকে ভালোবাসে”। [আবু দাউদ ও তিরমিযি একে সহীহ বলেছেন]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই পবিত্র, নির্মল ভালোবাসার গুরুত্ব বুঝেছিলেন। সমাজ ও জাতি গঠনে এবং পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে তা সহায়ক। তাই তিনি এমন কোন পরিস্থিতি এড়িয়ে যাননি যখন একজন মুসলিম অপর আরেকজন মুসলিমের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে। হৃদয়ের পংকিলতা দূর করতে এবং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করতে এই পবিত্রতা ছড়িয়ে দেয়া উচিত সকল হৃদয়ে।

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে একজন লোক অবস্থান করছিলেন, এমতাবস্থায় অন্য এক ব্যক্তি সেদিক দিয়ে যাচ্ছিল। প্রথম ব্যক্তি বললেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি এই লোকটিকে সত্যিই ভালোবাসি।” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি তাকে তা জানিয়েছো?” লোকটি বলল, না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “তাকে বল”। প্রথম লোকটি তাকে দৌড়ে ধরে ফেলল এবং বলল, “সত্যিই আমি তোমাকে আল্লাহর জন্যে ভালোবাসি”। লোকটি উত্তর করল, ” আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসুন যে আমাকে তাঁর জন্যে ভালোবাসে”। [আবু দাউদ, সহীহ]

হযরত মুয়ায রাদিয়াল্লাহু আনহু এই পবিত্র ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতেন মুসলিমদের মাঝে, এবং তিনি সেই বিরাট পুরষ্কার সম্পর্কে তাদেরকে বলতেন যা আল্লাহ তায়ালা প্রস্তুত করে রেখেছেন যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, যারা আল্লাহর জন্যে পরস্পরকে ভালোবাসে তাদেরকে আল্লাহও ভালোবাসেন।

ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ তাঁর আল-মুয়াত্তায় একটি সহীহ ইসনাদ বর্ণনা করেছেন, আবু ইদরিস আল-খুলানি থেকে। তিনি বলেন, “আমি দামেস্কের মসজিদে প্রবেশ করলাম, সেখানে আমি অল্প বয়স্ক একজন লোককে দেখলাম যার হাসি ছিল ঝলমলে উজ্জ্বল, এবং আমি লোকদের দেখলাম তাকে কেন্দ্র করে ভিড় করতে। যখন কোন একটি বিষয়ে তাদের মতানৈক্য হল, তারা যুবক লোকটির কাছে সে বিষয়টি উপস্থাপন করল এবং তার মতামত মেনে নিল। আমি জানতে চাইলাম, এই লোকটি কে ছিল , তারা আমাকে বলল, ‘ইনি মুয়ায ইবন যাবাল (রাদিয়াল্লাহু আনহু)’। পরদিন খুব সকাল সকাল আমি মসজিদে গিয়ে হাজির হলাম কিন্তু গিয়ে দেখলাম তিনি তারও আগে সেখানে উপস্থিত। তিনি নামাযরত ছিলেন, তাই আমি শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, এরপর আমি তার কাছে গেলাম, হাসি বিনিময় করলাম এবং বললাম, “আল্লাহর জন্যে আমি আপনাকে ভালোবাসি”। তিনি জানতে চাইলেন, “আল্লাহর জন্যে?” আমি বললাম, “আল্লাহর জন্যে”। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, “আল্লাহর জন্যে”? এবং আমি বললাম, “আল্লাহর জন্যে”। একারণে তিনি আমাকে আমার জামা ধরে টেনে তার কাছে নিলেন এবং বললেন, “তোমার জন্যে সুসংবাদ । আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, “আল্লাহ সর্বশক্তিমান বলেনঃ ‘আমার ভালোবাসা তাদের জন্য বরাদ্দকৃত যারা একে অপরকে ভালোবাসে আমার জন্যে, যারা একে অপরকে দেখতে যায় আমার জন্যে এবং যারা একে অন্যের প্রতি খরচ করে আমার জন্যে”।
Share: